Tuesday, October 4, 2011

ফিলিস্তিন : ৬০ বছরের রক্ত শুকাবে তো!


রোকন রাইয়ান
টানা ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা মরণক্ষয়ী যুদ্ধ আর ‘শান্তিচুক্তি’র মিথ্যে আশ্বাসে অতিষ্ঠ হয়ে এবার জাতিসংঘে স্বাধীনতার প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে পারমাণবিক নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সংঘাত বা পরিবেশের মতো জরুরি বিষয়গুলো আলোচ্যসূচিতে থাকলেও সবকিছুর ওপর ছায়া মেলে ছিল ফিলিস্তিনি ইস্যু।  ২৩ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আবেদন পেশের সময় সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত নেতারা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন সংগ্রামী জাতিটির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে। ওই ভাষণের কিছু সময় পরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এর সমালোচনা করে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন।
তবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা বিষয়ে জাতিসংঘের প্রেসিডেন্ট বান কি মুন পজিটিভ কথা বলেছেন। বিশ্বের নামি-দামি গবেষক ও সুশীল সমাজেও এর ইতিবাচক সাড়া লক্ষ করা গেছে।






এদিকে ফিলিস্তিনের মজলুম জনতা স্বাধীনতার জন্য প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যখন জাতিসংঘে ভাষণ দেন তখন ফিলিস্তিনের শহরে লক্ষাধিক জনতার একটি মিছিল দেখা গেছে। যাদের হাতে ছিল স্বাধীনতার দাবি সম্বলিত বিভিন্ন প্লাকার্ড।
ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিন জবরদখল করেছে ৬০ বছরের বেশি হলো। কিন্তু এখনো ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর চলছে গণহত্যা, জুলুম ও নির্যাতন। কথায় কথায় ফিলিস্তিনি জনগণকে পাখির মত গুলি করে মারা হচ্ছে, যখন তখন দল বেধে নিরপরাধ ফিলিস্তিনি জনগণকে ধরে নিয়ে জেলখানায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এমনকি ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনি জনগণের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছে এবং তাদের বিস্তৃর্ণ কৃষিজমির ফসলও নষ্ট করে ফেলছে। এ মুহূর্তে বিংশ শতাব্দির যে দুঃখজনক ও লোমহর্ষক ঘটনা নতুন সহস্রাব্দেও মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো বিশ্ব ইহুদিবাদী চক্র ও তাদের পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকদের মাধ্যমে ফিলিস্তিন জবরদখল।




ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মধ্যে মূলত সমস্যাটা শুরু হয় ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। যার ফলে মুসলিম জগতের গৌরব অস্তমিত হচ্ছিল, পাশ্চাত্য তখন মধ্যযুগীয় বর্বর যুগকে পেছনে ফেলে উন্নতির সোপানগুলো অতিক্রম করা শুরু করেছে মাত্র। মধ্যযুগের বর্বরতা থেকে ছাড়া পাওয়া পশ্চিমা পাগলা ঘোড়ার লক্ষ্য বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচার নয় বরং সাড়া বিশ্বে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা ছিল পশ্চিমাদের আসল উদ্দেশ্য। পতনোন্মুখ ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের দুর্বল অবকাঠামোর কারণে আগ্রাসী পশ্চিমা শক্তিগুলো মুসলিম সাম্রাজ্যে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায় এবং মুসলমানদের সম্পদ লুটপাটে মেতে ওঠে। এশিয়া থেকে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ওসমানিয়া সাম্রাজ্যকে পুরোপুরি ধ্বংসের জন্য পশ্চিমাদের দুটি টার্গেট ছিল। ওসমানিয়া সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেয়া এবং এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে পশ্চিমাদের তাবেদার সরকারকে ক্ষমতায় বসানো। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মিলনস্থলে অবস্থিত কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিনের ওপর তৎকালীন পশ্চিমা শাসকদের দৃষ্টি পড়ে। একই সাথে ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের ব্যাল শহরে থিওডর হার্যেলের নেতৃত্বে এবং বৃটিশ পূঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম ইহুদিবাদী মতাদর্শের জন্ম হয়। ফিলিস্তিনে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করে ওই ভূখন্ড দখল করে সেখানে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ইহুদিবাদী গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের মাধমে ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড- ফ্রান্সের ম্যান্ডেটে। ১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদিবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বেলফোর ঘোষণার মাধমে প্যালেস্টাইন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।
১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বৃটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের ধরে এনে জড়ো করা শুরু হলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ১৯৩১ সালে ইহুদিদের এই সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায়। এভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।
১৯১৮ সালে বৃটেনের সহযোগিতায় গুপ্ত ইহুদি বাহিনী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদিবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহিত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে নিজেদের মাতৃভূমির মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণা করে।


অসহায় ফিলিস্তিনের জন্য ইতিহাসটা বড়ই করুন। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা প্রস্তাবে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভেটো দিয়েছেন। আর ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বাধীনতার বিষয়ে তাদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আপত্তি তুলছেন। নেতানিয়াহু আশঙ্কা করে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজায় ইসলামি জঙ্গিরা দিন দিন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে।’
অসহায় ফিলিস্তিনের জন্য এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে, যাদেরকে ৬০ বছর যাবৎ রক্ত চুষে খেয়ে নিঃশ্বেষ করা হয়েছে সেই অসহায় দুর্বল চাল-চুলোহীন দেশটার ব্যাপারে ইসরায়েলের নিরাপত্তার আশঙ্কা!!


গত ৬ দশকের ফিলিস্তিন জবরদখলের ঘটনা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, ইহুদিবাদী ইসরাইল কোনোদিনও ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার মেনে নেবে না। এছাড়া ইহুদিবাদীদের সমর্থক পশ্চিমা বিশ্বও ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের মাতৃভূমি ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কোনো ব্যবস্থা নেবে, সে আশাও এখন সুদূর পরাহত। কাজেই কূটনৈতিক উপায়ে নিজেদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার ব্যাপারে হতাশ হয়ে এখন ফিলিস্তিনিরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের পাওনা আদায় করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গঠিত সংগ্রামী সংগঠনগুলোর প্রতিরোধ আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল সরকারের নাওয়া-খাওয়া ও ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সেই সাথে ফিলিস্তিনি জনগণের সম্পদ ও ভূখন্ড অবৈধভাবে দখল করে ইহুদিবাদীরা যে তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, প্রতিরোধ সংগ্রামের ফলে বিশ্ববাসী সে কথা জানতে পারছে। এদিকে ৬০ বছর ধরে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পরিচিতি অক্ষুন্ন রেখেছে। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম সাম্প্রতিককালে ইসরাইলের পতনের ঘন্টাধ্বনি শোনা যাবে এমনটাই ধারণা বিশ্বের দুইশ’ কোটি মুসলিমের। এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী অগণীত হাতের পাশে বিশ্বের কোটি কোটি হাত আল্লাহর দরবারে উত্তোলনের মাধ্যমে সেই কামনাই করছে প্রতিনিয়ত।

No comments:

Post a Comment

ভালো লাগা রইল... অনেক ধন্যবাদ